স্বদেশ ডেস্ক:
করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এক শ’তম দিন পূর্ণ হচ্ছে আজ। গত ১৭ মার্চ সরকারি নির্দেশে একযোগে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে আজ শনিবার পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধের এক শ’তম দিন পূর্ণ হলো। দীর্ঘ এই সময়ে সব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ৮০ ভাগ কমেছে। এক দিকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অন্য দিকে কোচিং, প্রাইভেট এবং গৃহশিক্ষকদের মাধ্যমেও বন্ধ রয়েছে পাঠদান। ফলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকা শিক্ষার্থীরা এখন বাসাবাড়িতেই অলস সময় কাটাচ্ছে। করোনায় ঘরবন্দী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। আগের চেয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় কমেছে ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ে ১০ ঘণ্টা পড়াশোনায় ব্যয় করলেও এখন ২ ঘণ্টার বেশি কেউই পড়াশোনা করছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে করোনার এই সময়ে শিক্ষার্থীদের শ্রমের হার বেড়েছে। আয়মূলক কাজে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জড়িত থাকলেও এখন এই হার বেড়ে হয়েছে ১৬ শতাংশ। পাশাপাশি শিক্ষার্থীর মনোকষ্ট, ভয় ও দুশ্চিন্তাও বেড়েছে। অন্য দিকে কমেছে শিক্ষার্থীদের আনন্দ। পড়াশোনা ও সৃজনশীল কাজকর্ম ছাড়া অন্যান্য কারণে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষার্থীরা গড়ে সময় কাটাচ্ছে ৩৮১ মিনিট।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রভাব ও অনলাইনে পাঠ গ্রহণের সাথে মানিয়ে নেয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য মুঠোফোনে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের সারা দেশের শহরের বস্তি (ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও সিলেট ছাড়া) এবং গ্রামের চার হাজার ৬৭২টি পরিবারের পাঁচ হাজার ১৯৩ শিক্ষার্থীর ওপর এই গবেষণা করা হয়। শিক্ষার্থীর পাশাপাশি মায়েদের সাক্ষাৎকারও নেয়া হয়। চলতি বছরের ৫ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত এ গবেষণাটি করেছেন মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ, বিআইজিডির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট অনিন্দিতা ভট্টাচার্য, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মনতাজিমা তাসনিম এবং রিসার্চ ইন্টার্ন ফারজিন মুমতাহেনা।
গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার আগে গ্রামের শিক্ষার্থীরা স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে প্রতিদিন গড়ে ৬২৫ মিনিট পড়ালেখায় ব্যয় করলেও এখন তারা মাত্র ১২৪ মিনিট পড়াশোনা করছে। অর্থাৎ দিনে ১০ ঘণ্টা পড়ালেখার সময় কমে এসেছে মাত্র ২ ঘণ্টায়। সেই হিসাবে ৮০ শতাংশ পড়াশোনার সময় কমেছে। এ ছাড়া টেলিভিশন ও অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারেনি। ফলে মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী টেলিভিশনে ‘ঘরে বসে শিখি’ ও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’- এই দু’টি অনুষ্ঠান দেখছে এবং ১ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছে। যারা টিভি ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে তারা আবার এই ক্লাস অনুসরণ করাকে বেশ কঠিন বলে মনে করছে।
গবেষণায় উঠে আসা প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে যেখানে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দুই ঘণ্টার বেশি আয়মূলক কাজে জড়িত ছিল, এখন তার হার দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে। আর গৃহস্থালি কাজকর্মের হার ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা করোনার আগে ছিল মাত্র ১ শতাংশ। সারা দেশে শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অভিভাবকদের ভূমিকার বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে এই গবেষণায়। গ্রামের ২৪ ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনার সহযোগী হিসেবে মা এবং ১৪ ভাগ শিক্ষার্থী বাবাকে পাচ্ছে। টেলিভিশনে ক্লাস করা ১২ ভাগ শিক্ষার্থীর বাবা-মা নিরক্ষর এবং ২৪ ভাগ শিক্ষার্থীর বাবা-মা এসএসসি কিংবা এর চেয়ে বেশি পড়াশোনা করেছেন। তবে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজে শিখছে বলেও গবেষণায় তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব থাকার পরেও ৬ শতাশং শিক্ষার্থী কোচিং এবং প্রাইভেট টিউটরের মাধ্যমে শিখছে বলেও দেখা গেছে। তবে পড়াশোনার সময় তুলনামূলক কমে গেলেও বেড়েছে শিশুশ্রমের হার।
এ প্রসঙ্গে বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন বলেন, আমাদের দেশের মূল শক্তি হলো কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্ভাবনী পদক্ষেপ। করোনায় এই মূল শক্তিটিকে অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। সেটি হতে পারে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে কিংবা শিক্ষা খাতে ডিজিটাল ব্যবস্থার উদ্ভাবনে। আমাদের অবশ্যই হাতে হাত মিলিয়ে এ ব্যাপারে কাজ করতে হবে।
গবেষক নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, দেশের শিশুদের পড়াশোনায় ব্যয় করা সময় ১০ ঘণ্টা থেকে কমে ২ ঘণ্টায় নেমে গেছে। গ্রামের শিশুরা এখন পরিবারের কাজের পেছনে দ্বিগুণ সময় ব্যয় করছে। শিক্ষামূলক কার্যক্রমে সময় না দিয়ে অন্যান্য কার্যক্রমে বেশি সময় দেয়ায় যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পূরণ করা কষ্টসাধ্য। স্কুল বন্ধ হওয়ায় ৬ ঘণ্টা বা ৫০ শতাংশ বেঁচে যাওয়া সময় আমাদের গবেষণায় ‘অ-গ্রহণীয়’। পরবর্তী ধাপে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে আরো গবেষণা করব।